
মোঃ শাহজাহান বাশার,সিনিয়র স্টাফ
গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকার টিএনটি বাজার জামে মসজিদের খতিব মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ মিয়াজীকে ঘিরে আলোচিত ‘অপহরণ ও উদ্ধার’ ঘটনাটি নতুন মোড় নিয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, ঘটনাটি প্রকৃত অর্থে কোনো অপহরণ নয়; বরং খতিব নিজ ইচ্ছায় আত্মগোপনে গিয়েছিলেন।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন জিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মোহাম্মদ তাহিরুল হক চৌহান।
টঙ্গী পূর্ব থানার সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ অক্টোবর বিকেল ৪টার দিকে খতিব মহিবুল্লাহ হঠাৎ নিখোঁজ হন। পরিবারের সদস্যরা ধারণা করেছিলেন, তিনি নামাজের জন্য মসজিদে গিয়েছিলেন এবং আর ফেরেননি। পরদিন অর্থাৎ ২২ অক্টোবর তার পরিবারের পক্ষ থেকে টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়, যেখানে অভিযোগ করা হয়— নামাজ পড়তে গিয়ে তাকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা অপহরণ করেছে।
এদিকে জিডির পরপরই টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশ ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে। ফুটেজে দেখা যায়, নিখোঁজ হওয়ার সময় খতিব মহিবুল্লাহ কোনো সংঘর্ষ বা জোরপূর্বক পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন না। বরং তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় একটি সিএনজি অটোরিকশায় উঠে এলাকার বাইরে চলে যাচ্ছেন। এ সময় তার সঙ্গে কাউকে দেখা যায়নি, যা ‘অপহরণ’ দাবিকে সন্দেহজনক করে তোলে।
পরবর্তী ২৩ অক্টোবর সকালে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থানার হেলিপ্যাড বাজার এলাকায় স্থানীয়রা এক ব্যক্তিকে একটি গাছের সঙ্গে শিকলবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে এবং পরে পরিচয় নিশ্চিত হলে জানা যায়, তিনি নিখোঁজ খতিব মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ মিয়াজী।
পরে তাকে চিকিৎসার জন্য তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে, ঘটনাটি তার নিজের ইচ্ছায় ঘটেছে। তবে কেন, কী উদ্দেশ্যে এবং কার প্ররোচনায় তিনি আত্মগোপনে গিয়েছিলেন— সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট কিছু জানাননি। পুলিশ জানিয়েছে, বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ তাহিরুল হক চৌহান সাংবাদিকদের বলেন,“প্রাথমিকভাবে এটি কোনো অপহরণের ঘটনা নয় বলে মনে হচ্ছে। তদন্তে দেখা গেছে, খতিব নিজেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন। কেন তিনি এমনটি করেছেন, সে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে যাচাই করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, বর্তমানে মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ মিয়াজী পুলিশের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন এবং তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন।
ঘটনাটি নিয়ে নতুন তথ্য দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামি। ফেসবুক পোস্টে তিনি জানিয়েছেন, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে সংগৃহীত চারটি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে— সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে খতিব মহিবুল্লাহ দ্রুত গতিতে একটি পাম্পের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।
অভিযোগ করা হয়েছিল, ফিলিং স্টেশনের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। কিন্তু ফুটেজে এরকম কোনো দৃশ্য পাওয়া যায়নি; বরং দেখা গেছে, তিনি একাই দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।
এ বিশ্লেষণ প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন— কেন একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হঠাৎ করে আত্মগোপনে যাবেন, তারপর নিজেকে শিকলবদ্ধ অবস্থায় হাজির করবেন?
পুলিশ বলেছে, ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ সত্য উদঘাটনে তারা কাজ করছে। খতিব মহিবুল্লাহ মিয়াজীর পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনের পটভূমিও তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার মোবাইল ফোনের কললিস্ট, অবস্থান, আর্থিক লেনদেনসহ সব দিক যাচাই করা হচ্ছে।
এ ঘটনায় টঙ্গী এলাকার সাধারণ মানুষ ও মসজিদ কমিটির সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, একজন সম্মানিত খতিবের এমন আচরণ সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আবার অনেকে মনে করছেন, হয়তো কোনো মানসিক চাপ বা ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
সব মিলিয়ে টঙ্গী থেকে নিখোঁজ হওয়া ও পঞ্চগড়ে উদ্ধার হওয়ার এ ঘটনাটি এখনো রহস্যে ঘেরা। তবে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এটি অপহরণ নয়, বরং আত্মগোপন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন হলে এ ঘটনার আসল উদ্দেশ্য ও পেছনের প্রভাবকরা কারা— তা পরিষ্কার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।





















