
কেউ যখন ভাবে সে হেরে গেছে, অন্য কেউ হয়তো সেই অবস্থানকেই তার স্বপ্নের উচ্চতা মনে করে। কেউ যখন আনন্দে আত্মহারা, সেই মুহূর্তে আরেকজন হয়তো হাহাকারে ভেঙে পড়ছে। এমন বৈপরীত্যে ভরা এই পৃথিবীর প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি সম্পর্কই নির্ভর করে সময়, স্থান, পরিস্থিতি ও ব্যক্তিগত মানসিক অবস্থার উপর। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় এক গভীর উপলব্ধি—জীবনের সবকিছুই আপেক্ষিক।
যে খাবার একদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় খেয়ে অমৃত মনে হয়েছিল, তা-ই আরেকদিন মনে হতে পারে বিস্বাদ। যে জায়গায় একদিন ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে কাটিয়েছিলে স্বপ্নময় সময়, সে জায়গাটাই পরবর্তীতে হয়ে উঠতে পারে হাহাকারের প্রতীক। একই কাজ, একই পরিস্থিতি, একই শব্দ—সময়ের প্রবাহে বদলে যায় তার অর্থ, রং আর অনুভব। তাই জীবনকে কখনোই চূড়ান্ত কিছু ধরে নেওয়া যায় না। একেকজনের দৃষ্টিতে একেকরকম ব্যাখ্যা, আর এখানেই জীবনের আপেক্ষিকতা।
আমরা অনেক সময় অন্যকে দেখে হীনমন্যতায় ভুগি। ভাবি, “সে কত দূর এগিয়ে গেছে, আমি কোথায়!” অথচ তার জীবনেও আছে না বলা কষ্ট, মুখে না আসা ব্যর্থতা। যে চাকরি না পেয়ে তুমি ভেঙে পড়েছো, কেউ হয়তো সে চাকরি পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে নিজের শান্তি। যে মানুষটিকে দেখে তুমি হিংসা করছো, তার হয়তো রাতের ঘুম নেই। জীবন তাই এক অদৃশ্য পর্দার খেলা—বাহ্যিক রূপ দেখে যার প্রকৃত রূপ বোঝা কঠিন।
একজন কৃষকের কাছে ভোরের সোনালি সূর্য মানে নতুন এক জীবনের শুরু, আবার এক রাতজাগা শহুরে ক্লান্ত মানুষের কাছে সেই সূর্য হয়তো আরেকটি বিষণ্ন দিনের ঘোষক। সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ—সবকিছুই তাই অবস্থানভেদে পরিবর্তিত। আমাদের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও মনোভাবই নির্ধারণ করে, আমরা কীভাবে জীবনকে দেখছি। আর তাই এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই নিরঙ্কুশ সত্য নয়, নেই কোনো চূড়ান্ত সংজ্ঞা—সবই আপেক্ষিক।
এই উপলব্ধি মানুষের ভেতরে জন্ম দেয় সহানুভূতি ও বিনয়ের। যখন বুঝতে শিখি, আমার যন্ত্রণাও কারও কাছে তুচ্ছ, আর কারও তুচ্ছ কষ্ট আমার কাছে হতে পারে অচিন্তনীয় বেদনার বিষয়—তখনই মন হয়ে ওঠে নম্র, হৃদয় হয় সহানুভূতির আধার। বিচার না করে বোঝার চেষ্টা করি, প্রতিযোগিতা না করে পাশে দাঁড়াই।
জীবনের আপেক্ষিকতা আমাদের শেখায় সবকিছুকে নির্ধারণ করার আগে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে। অন্যকে ছোট করে নয়, বরং নিজেকে বড় করে ভাবতে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই পারে সমাজে এনে দিতে একটুকু সহনশীলতা, একটুকু মানবিকতা।
কারণ জীবন একটাই। কিন্তু তার রং, স্বাদ আর ব্যথা—প্রতিটি মানুষ ভিন্নভাবে অনুভব করে। কেউ হাসছে, কারণ সে কাঁদতে চায় না। কেউ চুপ করে আছে, কারণ বোঝানোর ভাষা খুঁজে পায় না। কেউ জিতছে, তবু ভেতরে হেরে যাচ্ছে। আবার কেউ হেরে গিয়েও অর্জন করছে এক অনন্য জ্ঞান। তাই জীবনকে কখনোই একটি মাত্র মানদণ্ডে মাপা যায় না।
জীবনের সবকিছুই আপেক্ষিক এই উপলব্ধি যে যত গভীরভাবে ধারণ করতে পারে, সে ততটাই শান্ত, ততটাই পরিপূর্ণ।