
মো: মোসলেম উদ্দিন সিরাজী সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি
তারিখ : ০২/০৮/২০২৫ ইং আশির দশকের কথা। শাহজাদপুরের গাড়াদহ গ্রাম। ছিমছাম, সাজানো-গোছানো আমার গ্রামটি।
দুই পাশে দুই নদ-নদী। পূর্ব পাশে করতোয়া নদী, পশ্চিম পাশে ফুলজোড় নদ। গ্রামের লোকজন সারা দিন কাজকর্ম করে বিকেলে দুই নদীর তীরে সময় কাটায়, গল্প করে। গ্রামে একটি জিনিসের অভাব ছিল হাট। হাট করার জন্য বাইরের গ্রামে যেতে হয়। গ্রামে আছে সুবিশাল মাঠ। একদিন পুরো গ্রামের লোক ডাকা হলো। সলিমুল্লাহ চাঙা এই গ্রামের মুরব্বি। তাঁর কথা সবাই মানে। তিনি বললেন, এই গ্রামে একটি হাট দরকার, কী বলেন সবাই? সমস্বরে সবাই বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। গ্রামের একেবারে উত্তর পাশে হাটের জায়গা ঠিক করা হলো। একটি বিশাল বটগাছ, বটগাছের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু নদী। সপ্তাহের বুধবারে হাট বসে। হাটের জৌলুশ ছিল, প্রাণ ছিল। মানুষের সমাগমে প্রতি বুধবার সারা গ্রাম মেতে থাকত। বটগাছের পাশেই বসত মাছের বাজার। নদী ও বিলের মাছে ভরে উঠত মাছবাজার। তার আরেক পাশে সন্দেশ, মটকা, গজা, চিটকা খাজা ও জিলাপি। জিলাপি দিত পদ্মপাতায়। আরেক পাশে মাটির হাঁড়িপাতিল, পুতুল, খেলনা। যখন কোনো হাঁড়িপাতিল কিনতে যেতাম, পালেরা ঠন ঠন করে হাঁড়িপাতিল বাজাতেন। মাঝখানে বসত টাটকা সবজির বাজার। তার এক পাশে বস্তায় করে ধান বিক্রি হতো। সবচেয়ে ভালো লাগত গণেশ নাপিতকে। টুলে বসে চুল কাটতেন। সারা গ্রামের তথ্য থাকত তাঁর কাছে। চারপাশে বসে লোকজন তাঁর গল্প শুনত। বেশির ভাগ গল্পই মেয়েদের নিয়ে। কার মেয়ের কার সঙ্গে প্রেম, কার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রামটা রসাতলে গেল, কোনো বিচার নেই ইত্যাদি। কোনো কোনো বিকেলে লোকজনের দৌড়াদৌড়ি শুরু হতো, যেদিন ইলিশ মাছ খুব সস্তা যেত। তখন টাকাপয়সার খুব অভাব ছিল। আমরাও সস্তায় আস্ত একটি ইলিশ মাছ নিয়ে এসে রাতে মজা করে খেতাম। যখন শর্ষের মৌসুম আসত, তখন বুধবারের হাট নতুন রূপে সাজত। হাটটি ছোট হওয়ায় রাস্তার দুই পাশে বিক্রেতারা চাটাই বিছিয়ে বসতেন, শর্ষে বিক্রেতাদের কাছে থাকত একটি করে টাকার তহবিল। অনেকেই শর্ষে কিনে খাঁটি শর্ষের তেল খেতেন। আমরাও শর্ষে কিনে মানিতে শর্ষে ভাঙাতাম। হাটের একেবারে দক্ষিণ পাশে বসত ধানের বাজার। একেক মৌসুমে একেক রকম ধান। যখন আমন ধান উঠত, তখন গ্রামের লোকজনের পিঠা খাওয়ার আয়োজন শুরু হতো। ঠিক বটগাছের নিচেই বসত সুরেশ কাকার পানের দোকান। সুরেশ কাকার ছিল বিশাল ভুঁড়ি। অধিকাংশ সময়ই খালি গায়ে থাকতেন। দোকানের চারপাশে পান, সুপারি, জর্দা সাজানো থাকত। আমরা দোকানের পাশে গেলেই সুরেশ কাকা বলতেন, ‘পান নিবা খোকা।’ নানার জন্য প্রতি বুধবারেই পান-সুপারি নিয়ে আসতাম। সুরেশ কাকা শহর থেকে সবচেয়ে বড় পান এনে বুধবারের হাটে বিক্রি করতেন। হাটের একেবারে রাস্তার পাশে ছিল দু-তিনটি মণিহারি দোকান। এই দোকানগুলো হাটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। এই মণিহারি দোকানগুলোতে সারা বছরই বেচাবিক্রি হতো। বছর শেষে হালখাতা হতো, যারা বাকিতে খেত, তাদের বাকি টাকা তোলার এই এক সুন্দর ব্যবস্থা। হালখাতায় খাওয়ানো হতো লুচি, পায়েস, রসগোল্লা
যখন সন্ধ্যা নেমে আসত, তখন বুধবারের হাটে জীবনের লেনদেন কমে আসত। দোকানিদের শরীর ক্লান্ত-শ্রান্ত হতো, তখন অনেকেই নদীতে গোসল করে ক্লান্তি দূর করত। গোসল সারার জন্য অনেক দোকানদার একটি গামছা ও লুঙ্গি সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। সন্ধ্যার পরও লণ্ঠনের আলোয় বুধবারের ছোট হাটখানি আলোতে ভরে উঠত। অনেক কর্মব্যস্ত মানুষ সন্ধ্যার পরেও হাটে ছুটে আসতেন। কেউ কিছু কিনুক না কিনুক, বুধবারের এই হাটে যেন আসতেই হবে। এই হাটখানি যেন সবার সুখ-দুঃখের সাথি। হাট যখন একেবারে শেষ হয়ে যেত, সব দোকানদার বাড়ি ফিরে যেতেন। তখন জোৎস্নার আলোয় অনেকেই গোল হয়ে বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করত। তারপর যে যার মতো সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে বাড়ি ফিরে যেত। যেন আনন্দ-বেদনার সাক্ষী এই মমতাতরা ছোট হাট। এখন বুধবারের হাট আর বসে না। কয়েকটি ভগ্নপ্রায় দোকান কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই হাটের। সেই শর্ষের ঘ্রাণ, সেই আমন ধান, সেই ইলিশ মাছ, গণেশ কাকা, লণ্ঠনের আলো, পদ্মপাতায় জিলাপি আবার কি ফিরে পাব কোনো দিন! অনেকেই বলছে, এই হাট আবার চালু করা দরকার। কবে চালু হবে এই হাট জানি না